Ads

Sunday 17 May 2015

বৃষ্টির পেছনের বিজ্ঞান

বৃষ্টির পেছনের বিজ্ঞান


“মেঘ মাদলে ভরা বাদলে
বরষা বুঝি আসে ওই।
জল বরণে তৃষিত
মন ভিজিয়ে হাসে ওই।”
বৃষ্টির সৌন্দর্যের দিক থেকে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের মত ভাগ্যবান মানুষ মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সব দেশে তেমন বৃষ্টি হয় না। প্রায় দেশেই তুষারপাত হয়। বরফে ঢাকা, কিংবা মাইলের পর মাইল মরুভূমি। আবার সব দেশে টিনের চাল নেই। বাংলাদেশের মানুষদের জন্য আশ্চর্য এক সমাবেশ ঘটেছে ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি আর টিনের চাল। ঝমঝম করে যখন টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে তখন যে কী স্বর্গীয় এক সুখানুভূতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বৃষ্টি এতোটাই পাগলকরা যে তার প্রেমে একজন পাকিস্তানিকেও বাংলাদেশে থেকে যেতে দেখা যায়।
বৃষ্টি ব্যাপারটা এতই সুন্দর মনোহর আর গ্রহণযোগ্য যে অনেক লেখক কবি শিল্পীই এটা নিয়ে কিছু না কিছু সৃষ্টিকর্ম করেছেন। তাদের বেশিরভাগই বৃষ্টির সৌন্দর্য বৃষ্টির কাব্যিক বর্ণনা। বৃষ্টির ভেতরকার রসায়ন, বৃষ্টির ভেতরের ভৌতবিজ্ঞান, বৃষ্টির কলাকৌশল নিয়ে সে তুলনায় খুব কমই আলোচনা হয়েছে। আমরা আজকে বৃষ্টির ভেতরের বিজ্ঞান, বৃষ্টির মেকানিজম সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে যাচ্ছি। বৃষ্টির ভেতরের বিজ্ঞান একটা ক্লাসিক কবিতা বা উপন্যাস থেকে কোনো দিক থেকে কম মনোহর নয়।
পৃথিবীর চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই সমুদ্র। সে সমুদ্রে অবিরত সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের সে আলোকের তেজ প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানিকে বাষ্প করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু সমুদ্রই না, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, থেকেও বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় পানি বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এমনকি গাছের পাতা থেকেও জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পানির কণা বাতাসে মিশছে। গাছ তার মূল দিয়ে মাটির নিচ হতে পানি সংগ্রহ করে। কিছুটা পানি তার নিজের কাজে লাগায় বাকি বেশখানিকটা পানি তার কাজে লাগে না। অবশিষ্ট সেই পানি সে ছেড়ে দেয় বায়ুমণ্ডলে। এমন নানা উপায়ে আসা বায়ুমণ্ডলের সকল বাষ্প-রূপ পানি আস্তে আস্তে ওঠে যায় উপরে। উপরে গিয়ে বিশাল যজ্ঞ, নানান শর্ত সাপেক্ষে সে মাঝে মাঝে বৃষ্টি, মাঝে মাঝে তুষার, মাঝে মাঝে শিলা হয়ে ঝড়ে পড়ে। একই জিনিসের নানান রূপ।
**
প্রত্যেকটা বস্তুই অণু-পরমাণু সমন্বয়ে গঠিত- এমনকি পানিও। একটা বস্তুর মাঝে অণু-পরমাণুগুলো সদা কম্পনশীল কিংবা চলনশীল। কঠিন পদার্থের বেলায় অণুগুলো কম্পনশীল, এবং বায়বীয় বা তরল পদার্থের বেলায় অণুগুলো চলনশীল। এর মাঝে তরল পদার্থের অণুগুলো বায়বীয় ও কঠিনের মাঝামাঝি একটা বৈশিষ্ট্যের আচরণ প্রদর্শন করে।
চিত্র: বস্তুর কণাগুলো সবসময়ই চলাচলরত অবস্থায় আছে কিংবা কম্পনরত অবস্থায় আছে।
পানির অণুগুলো চলনশীল- এখান থেকে ওখানে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে বেড়ায়। পানির যে সকল অণুগুলো উপরিতলের পানি-পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে তাদের গতিশক্তি একটু বেশি হয়ে থাকে। এর কারণ হচ্ছে কোনো বস্তুর উপর যখন তাপ শক্তি এসে পড়ে তখন বস্তুর কণা সে তাপশক্তি শোষণ করে নিয়ে অধিক পরিমাণ গতিশক্তি অর্জন করতে পারে। আর নদী-সমুদ্রে বিরতিহীন ভাবেই সূর্যের তাপ আসছে এবং সবচে বেশি তাপ পাচ্ছে সমুদ্রের উপরের স্তরের পানিগুলোই। এমনি করে সমুদ্রের পৃষ্ঠের দিকের কণাগুলো লাফাতে লাফাতে একসময় পানির বাইরে বায়ুর জগতে প্রবেশ করে ফেলতে পারে। পানি সাধারণত তার সহজাত আকর্ষণ ধর্ম দিয়ে কণাগুলোকে আটকে রাখে, কিন্তু যদি গতিশক্তি সেই আকর্ষণ শক্তির চেয়ে বেশি হয় তাহলে পানির আকর্ষণকে ডিঙ্গিয়ে সে পানি কণার বাতাসে মিশে যায়।

চিত্র: পানির অণুগুলো যে হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে দুর্বলভাবে পরস্পর যুক্ত সেখানে সূর্যের তাপ কিংবা অন্য কোনো তাপ শক্তি এসে পড়লে অণুগুলোর গতিশক্তি হাইড্রোজেন বন্ধনীর শক্তিকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে। এভাবেই পানির কণা বাতাসে মিশে যেতে পারে।
শুধু সমুদ্র থেকেই যে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে যায় তা না। বাতাস থেকেও বাষ্পের কণা সমুদ্রে আসে। বাতাসে ওঠে যাওয়া কণাগুলো বাতাসেও লাফালাফি করে বেড়ায়। সেই লাফে আবার বাতাস থেকে পানিতে এসে পড়ে। তবে মোটের উপর পানি থেকে বাতাসেই যায় বেশি। বাতাস সবসময় এক অবস্থানে থাকে না। খুব দ্রুত তার অবস্থান পরিবর্তন করে। জলীয় বাষ্প মিশ্রিত যে বাতাস সেটা থাকে কিছুটা ভারী। এটা খুবই স্বাভাবিক যে সাধারণ বাতাসের যে ভর হবে তার সাথে জলীয় বাষ্প মিশ্রিত হলে সে বাতাসের ভর কিছুটা বেড়ে যাবে। এই ভারী বাতাস থাকে বায়ুমণ্ডলের একদম নিচের দিকে- পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি। উপরের দিকে থাকে হালকা বাতাস। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারী ও হালকা বাতাসের মাঝে সমতা না আসবে ততক্ষণ তারা তাদের অবস্থান একের সাপেক্ষে অপরজন পরিবর্তন করে যাবে। ভারী বাতাস উপরে ওঠবে হালকা বাতাস নিচে নামবে। এভাবে বাতাসের একটা পরিচলন গতির সৃষ্টি করে।

চিত্র: জলীয় বাষ্প ধারণকারী বাতাস ক্রমান্বয়ে উপরে ওঠে যায়।
আমরা হয়তো পানি গরম করার সময় খেয়াল করে থাকব পানি যখন ফুটে ওঠে তখন পানিগুলো চলাচল করতে শুরু করে। পানির এই চলাচলটা হচ্ছে পরিচলন প্রবাহ। পানি [তরল] তার ধারণকারী পাত্রের মাঝখান দিয়ে উপরে ওঠে এবং কিনারা ঘেঁসে আবার নিচে চলে যায়। ঠিক এই প্রক্রিয়াটাই চলে জলীয় বাষ্পহীন শুষ্ক বাতাস এবং জলীয় বাষ্পধারী সিক্ত বাতাসের মাঝে।
এই কারণটার জন্যই আমরা কাপড় শুকাতে পারি। নইলে সূর্যের তাপে ভেজা কাপড় গরমই শুধু হয়ে যেত শুকাতো না কখনো। সমুদ্রের পানি পৃষ্ঠের কাছাকাছি কিংবা কাপড়ের কাছাকাছি চারিদিকে বাতাস জলীয় বাষ্প দ্বারা সিক্ত হয়ে যায়- আর বাতাসের মাঝে বাষ্প ধারণের একটা সীমা আছে। চাইলেই বাতাস অধিক পরিমাণ বাষ্প নিজের বুকে নিয়ে রাখতে পারে না। ধরা যাক কাপড়ের আশে পাশে কিছুটা অঞ্চল সিক্ত হয়েছে। এখন সেখানে নতুন করে শুষ্ক বাতাস এলে কাপড় আবার কিছুটা জল ত্যাগ করতে পারবে। এভাবেই বাতাসের আসা যাওয়ার মাধ্যমে একটি ভেজা কাপড় শুকায়।

চিত্র: বাতাসের চলাচল আছে বলে বাতাসে ভেজা কাপড় রাখলে সে কাপড় শুকিয়ে যায়।
আবার একই ব্যাপার ঘটে গরমের দিনে পাখার বাতাস, কিংবা ইলেকট্রিক ফ্যানের বাতাসের মাঝে। মানুষ যখন একটা স্থানে থাকে তখন তার শরীরের গরম আশেপাশের বাতাসে সঞ্চালিত হয়ে যায়। বাতাস তাপের জন্য তেমন ভাল একটা পরিবাহী নয়, তাই সে বেশি এলাকা পর্যন্ত শরীরের তাপ নিয়ে যেতে পারে না। যখন শরীরের আশেপাশের বাতাস গরম হয়ে ওঠে তখন মানুষের “গরম” লাগে। তবে কোনোভাবে যদি বাতাসের মাঝে প্রবাহের সৃষ্টি করা যায় তবে গরমটা কেটে যায়। এর মেকানিজমটা এরকম- বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি হলে শরীরের পাশে থাকা বাতাস অন্যত্র চলে যায় এবং নতুন বাতাস এসে হাজির হয়। সে বাতাস কিছুটা তাপ শুষে নিতে পারে। একসময় নতুন এই বাতাস গরম হয়ে ওঠার আগেই আরেক পশলা বাতাস এসে হাজির হয়। ফলে আমরা অনুভব করি ঠাণ্ডা।
সিক্ত বাতাস বা আর্দ্র বাতাস যখন আস্তে আস্তে বায়ুমণ্ডলের উপরে ওঠতে থাকে তখন সে বাতাস স্বল্প চাপের সম্মুখীন হয়। বায়ুমণ্ডলের যত উপরে যাওয়া যাবে বাতাসের চাপ তত কমবে। কম চাপের এলাকায় গিয়ে অধিক চাপের বাতাস হুট করে প্রসারিত হয়ে যায়। চাপ কমলে গ্যাসের তাপমাত্রা কমে যায়। এ নিয়ে গ্যাসের সূত্র আছে। একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেমে যখন কিছুটা গ্যাস স্বল্প আয়তনে অধিক চাপের মাঝ থেকে হুট করে অল্প চাপ ও অধিক আয়তনের মাঝে এসে প্রসারিত হবার সুযোগ পায় তখন সে গ্যাসটা খুব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে গ্যাস তরলও হয়ে যায়। গ্যাস লাইটারের মাঝে আমরা যে তরল গ্যাস দেখতে পাই তা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তৈরি। বায়ুর এই ঠাণ্ডা হবার ব্যাপারটা মোটামুটি জুল-থমসন প্রভাবের মত।  আর্দ্র বাতাস উপরে ওঠে প্রসারিত হয়ে শীতল হয়ে পড়ে। শীতল হয়ে পড়ে জলীয় বাষ্পগুলোও। জলীয় বাষ্পগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা বা বরফ কণা হয়ে ভাসতে থাকে। এদেরকেই আমরা ভাসমান মেঘ বলে দেখি।

চিত্র: মেঘ রূপে আমরা যা দেখি সেগুলো আসলে শীতলিত জলকণা বা বরফকণার দলবদ্ধ অবস্থান।
বাষ্প থেকে বরফ কিংবা জল হয়ে গেছে তাই হিসেবে এখন এদের মাটিতে পড়ার কথা। কিন্তু এই জলকণা বৃষ্টি বা তুষার কিংবা শিলা হয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটা মোটেই এত সরল নয়। জলকণা ও বরফ কণাগুলো এতই ক্ষুদ্র যে এদের হিসাব করতে রীতিমত ন্যানোমিটার, মাইক্রন একক ব্যবহার করতে হয়। এত ক্ষুদ্র কণা অনায়াসেই বাতাসে ভর করে ভাসতে পারে। নিচে বৃষ্টি হয়ে নামার জন্য দরকার ঘনীভবন। পানি যখন তরল অবস্থা থেকে বায়বীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে বায়ুতে মিশে তখন সে প্রক্রিয়াটাকে বলে বাষ্পীভবন। যখন এই প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীতটা ঘটে, বাষ্প থেকে পানিতে পরিণত হয় এবং নিচে নেমে আসে তখন সে প্রক্রিয়াটাকে বলে ঘনীভবন। ঘনীভবনটা আবার এমনি এমনি হয়ে যায় না। ঘনীভবন সংঘটন করতে দরকার হয় প্রভাবকের। পৃথিবীর এই বায়ুমণ্ডলটা যদি একদম শতভাগ পরিষ্কার হতো তাহলে কখনোই জলীয় বাষ্পগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ত না। এমনকি ঠাণ্ডা হতে হতে অতি সম্পৃক্ত হয়ে গেলেও হতো না। গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে পরিষ্কার বাতাস নিয়ে জলীয় বাষ্পের এই পরীক্ষাটি করে এমন ফলাফলই পাওয়া গেছে। যে জিনিষটা বায়ুমণ্ডলে ঘনীভবন ঘটিয়ে বৃষ্টির সৃষ্টি করে সেটা খুব নগণ্য একটা উপাদান। ধুলাবালি। ধুলাবালি বলতে সকল প্রকারের “ডাস্ট” কণাগুলোকে বুঝানো হচ্ছে। এর মাঝে লবণের কণাও আছে।বাতাসে ভাসমান পানির কণাগুলো যখন ঘনীভূত হবে তখন তার একটা আশ্রয় বা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। নিচের বায়ুমণ্ডলীয় স্তর থেকে পানির কণা সহজে ঘনীভূত হতে পারে কারণ সেখানে অবলম্বন হিসেবে সমুদ্র কিংবা অন্য কোনো আধার আছে। উপরের স্তরে সমুদ্র নেই, গাছপালা নেই, মাটি নেই, বাড়িঘরের পৃষ্ঠ নেই, কিছু নেই। সেখানে আধার হিসেবে কাজ করে বায়ুতে মিশে থাকে ধুলাবালি। বায়ুর তুলনায় ধুলাবালি আসলেই হিসেবের বাইরে নগণ্য একটা জিনিস। কিন্তু নগণ্য হলেও সেটাই বৃষ্টি সংঘটনের মূল হোতা। পানি চক্রের যে ধারা না থাকলে মানুষের পক্ষে জীবন ধারণ করা সম্ভব হতো না সে পানি চক্র এক নিমেষে শেষ হয়ে যেত এই নগণ্য ধুলাবালি না থাকলে।

চিত্র: বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা ধূলিকণাকে আশ্রয় করে ঘনীভূত হয় বাষ্প। ফলে সৃষ্টি হয় বৃষ্টি।
আপাত দৃষ্টিতে খুব অল্প মনে হলেও বাতাসে প্রচুর পরিমাণ ধুলা মিশ্রিত আছে। ইতস্তত উড়ে যাওয়া ভূ-পৃষ্ঠের ধুলা, যানবাহন কলকারখানার ধোঁয়া, সমুদ্রের লবণ কণা ইত্যাদি কণা মিলিয়ে বিশাল পরিবার ভেসে বেড়াচ্ছে।
ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় তখন মাটি ও বালির ছোট ছোট কণা বাতাসে গিয়ে মিশে। কলকারখানার কয়লা, যানবাহনের তেল পুড়িয়ে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা গিয়ে মিশে বাতাসেই। আগ্নেয়গিরি হতে অগ্নুৎপাতের সময় প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া বাতাসে মিশছে। দাবানল উল্কাপাতের ফলে ধূলিকণা গিয়ে মিশে। আছে মহাজাগতিক সূক্ষ্ম কণা। মহাজাগতিক ক্ষুদ্র বস্তুগুলো পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সময় বায়ুমণ্ডলে পুড়ে ধূলিকণা হিসেবেই তো থেকে যায়। সমুদ্র থেকে লবণ কণা গিয়ে মিশে। সমুদ্রের এদিক সেদিক ঢেউয়ের ফলে কিছু পানি ছিটকে বেরিয়ে আসে। এই সময় তাৎক্ষনিকভাবে সামান্য পরিমাণ পানির বাষ্পীভবন ঘটে। আর পানির সাথে ক্ষুদ্র পরিমাণে লবণের কণাও থাকে। এই শুকনো লবণের কণাও বাতাসে ভাসতে থাকে। পরিচলন প্রবাহে সেও আস্তে আস্তে উপরে ওঠে যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে প্রতি এক সেকেন্ডে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১০০০ টি লবণের কণা বাতাসে মিশতে পারে। আণবিক লেভেলে এক হাজার যদিও ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা তারপরেও এটি যথেষ্ট। এখানে যে অনেক কণা ক্ষয় হয়ে যায় সে হিসেবটাও ধরা হয়েছে। মানে ধরা যাক কিছু পরিমাণ ধূলিকণা তার দশার মধ্য অবস্থায় আছে। এমন সময়ে বৃষ্টি হলে বৃষ্টি সে কণাগুলোকেও সাথে নিয়ে ভূমিতে পতিত হবে। এই হিসেবে কিছুটা বেশি পরিমাণ ধূলিকণার দরকার আছে। আর সেটি কেটেকুটে গিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে আছে।
এই ধূলিকণাগুলো পানি প্রেমী বা হাইগ্রোস্কোপিক ধরণের হয়ে থাকে। এই ধূলিকণাগুলোকে কেন্দ্র করে, ভিত্তি ধরে পানির কণাগুলো ঘনীভূত হয়। পানি প্রেমের দিক থেকে লবণের কণা অনেক এগিয়ে! বর্ষা কালে তো লবণ খোলা পাত্রে রাখাই যায় না। খোলা পাত্রে রাখলে লবণ আশপাশ হতে পানির সংযুক্তি ঘটিয়ে গলে যায়। ধূলোবালি, লবণ ইত্যাদি কণাগুলোর গঠনই এরকম যেন তার কেলাসের মাঝে জলীয় বাষ্প আকরে ধরে লেগে থাকতে পারে। এই কণাগুলোকে কেন্দ্র করে মেঘ ঘনীভূত হয় তাই এই কণাদের বলা হয় “নিউক্লিয়াস”। বাংলায় বলা যেতে পারে কেন্দ্র বা ধুলিবীজ।

চিত্র: সবচে ক্ষুদ্র কণাগুলো হচ্ছে ধূলিবীজ যেগুলোকে কেন্দ্র করে মেঘ গড়ে ওঠে। এই ক্ষুদ্র আঁকারের তুলনায় নিচে একটি দুই মিলিমিটারের বৃষ্টির ফোটার অংশ। পরিধির একটা ছোট অংশই এ তুলনায় অনেক অনেক বিশাল।
অতিশীতল বরফকণার আশে পাশে শীতল জলকণা থাকলে সে জলকণার গা হতে পানি বাষ্পীভূত হয়ে ধীরে ধীরে বরফের গায়ে লেগে জমাট বাধতে শুরু করে। ১৯২২ সালের দিকে বিজ্ঞানী বের্গেরসন ও ফিনডাইসন পরীক্ষা করে এমনটাই দেখতে পান। বাতাসে অসংখ্য বরফ কণা ভেসে বেড়ায়। বিমান চালনার সময় আগের সময়ে বিমানের পাখাগুলোয় বরফ লেগে অসুবিধার সৃষ্টি করত। এখন অবশ্য এই অসুবিধা কাটিয়ে ওঠা হয়েছে, প্রযুক্তি অনেক আধুনিকায়িত হয়েছে।
বরফের গায়ে এমন করে পানির কণা লেগে লেগে একসময় ভারী একটা কণার সৃষ্টি করে। এবং একসময় সে ভারটা পর্যাপ্ত পরিমাণ হয় এবং অভিকর্ষের টানে নিচে নেমে আসে। তার মানে হচ্ছে আমরা বৃষ্টি রূপে যে তরল পানির দেখা পাই সেটা আসলে সৃষ্টির সময় বরফ আকারেই সৃষ্টি হয়।
বরফের অংশটা যখন বেগ ধারণ করে নিচের দিকে পড়তে শুরু করে তখন বায়ুমণ্ডলের বাতাসের সাথে ঘর্ষণে লিপ্ত হয়। ঘর্ষণ হলে তাপ উৎপন্ন হয়। বাতাসের ঘর্ষণে যে তাপ হয় সে তাপে গলে যায় বরফ। আমরা পাই তরল বৃষ্টি। যে এলাকায় বৃষ্টি হয় সে এলাকার বাতাসের চাপ যদি অনেক কম হয় সাথে সাথে তাপমাত্রাও থাকে খুব অল্প তাহলে সেখানকায় এটা শিলাবৃষ্টি আঁকারে ঝড়ে পড়বে।

চিত্র: পানি রূপে আমরা যে বৃষ্টি দেখি তার জন্ম হয় তুষার বা বরফ আঁকারে।  

পানি চক্রের কারিগর
পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে যাবে যদি পানিচক্র না থাকে। এই পানি চক্রকে সচল রাখার প্রধান ভূমিকাটা পালন করে বৃষ্টি। ডাঙ্গা থেকে যে পরিমাণ পানি বাষ্প হয়ে বায়ুমণ্ডলে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। সমুদ্র থেকেই পানি বাষ্পীভূত হয় বেশি। প্রতি বছর ডাঙ্গা ও সমুদ্র থেকে ১২৪,০০০ ঘন মাইল পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে। ১০৯,০০০ ঘন মাইল যাচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে আর বাকি ১৫,০০০ ঘন মাইল পানি যাচ্ছে ডাঙ্গা হতে। পানি যখন ফেরত আসে তখন ৯৮, ০০০ ঘন মাইল পড়ে সমুদ্রে আর ২৬,০০০ ঘন মাইল পড়ে ডাঙ্গায়। এই দিক থেকে ডাঙ্গায় পানি বেশি আসছে ১১,০০০ ঘন মাইল ! এটা মানবজাতি সহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য বিশাল আশীর্বাদ। আবার ডাঙ্গায় পড়া পানি কোনো না কোনো একভাবে সমুদ্রে পৌছাতে হয়। নইলে পানিচক্র রক্ষা হবে না। এই পানি নদীনালা হয়ে কিংবা মাটি কর্তৃক শোষিত হয়ে ঠিকই সাগরে মিলিত হয়।

চিত্র: পানি চক্র। 
এভাবে ওভাবে ব্যবহারের ফলে পানি আস্তে আস্তে নোংরা হয়ে যায়। বৃষ্টি আমাদের সে নোংরার হাত থেকে বাঁচায় নতুন পানি সরবরাহের মাধ্যমে। গাছপালা ফসল ফলাদি ফলানোর জন্য বৃষ্টি যে কত পরিমাণ বন্ধুর পরিচয় দেয় তা কি বলে শেষ করা যাবে? বৃষ্টি আসলেই মানুষের জন্য বড় এক আশীর্বাদ।
বৃষ্টির ফোঁটা
বৃষ্টি যেভাবে গঠিত হয় এবং যেভাবে পতিত হয় সে হিসাব করলে বৃষ্টির ফোঁটা অনেক বড় হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে একটা সীমার চেয়ে বড় ফোঁটা হয় না। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির চেয়ে ছোট হতে পারে যেটা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামে পরিচিত। কিংবা এমনও হতে পারে একই বৃষ্টির মাঝে ফোঁটাও আছে গুড়িও আছে। বৃষ্টির ফোঁটা বেশি বড় না হতে পারার পেছনে কাজ করে যে নিয়ম সেটি পৃষ্ঠটান বা সারফেস টেনশন। তরলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবসময় সে চেষ্টা করবে স্বল্প ক্ষেত্রফলে অধিক পরিমাণ আয়তন দখল করতে। এই দিক থেকে অন্য যেকোনো আকৃতির চেয়ে গোলাকার আকৃতি সবচে কম ক্ষেত্রফল রচনা করে। সেজন্য বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গোলাকার হয়ে থাকে। এখানে আরেকটা জিনিস খেয়াল করার মত- ধরা যাক বড় একটি ফুটবল আকৃতির বৃষ্টির ফোঁটা আছে। এখন সে বড় ফোঁটা ভেঙ্গে গিয়ে অনেকগুলো ছোট ছোট ফোঁটার সৃষ্টি করল। তাহলে ছোট ছোট সবগুলো ফোঁটা মিলে যে আয়তন হবে সেটা বড় ফোঁটার আয়তনের সমান। কিন্তু এখানে আয়তন সমান হলেও ক্ষেত্রফল সমান হয় না। বড় ফোঁটার যে ক্ষেত্রফল তার চেয়ে কম ক্ষেত্রফল হয় ছোট ফোঁটার। আর তরলের ধর্মও হচ্ছে স্বল্প ক্ষেত্রফলে অধিক আয়তন দখল করা। তাই অল্পতেই বড় ফোঁটাগুলো ছোট ছোট ফোঁটায় পরিণত হয়ে যায়। জলের ফোঁটাগুলোর ব্যাস তিন মিলিমিটারের বেশি হলেই সেটি ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা দেখায়। আরও একটি কারণ আছে- যখন একটি বৃষ্টির ফোঁটা নিচে নামতে শুরু করে তখন তার মাঝে বাতাসের বাধা এসে উপস্থিত হয়। বড় ফোঁটার মাঝেও পৃষ্ঠটান আছে। কিন্তু বড় ফোঁটার জন্য বাতাসের যে বাধা সে পরিমাণ টান পানি-পৃষ্ঠে নেই। তাই ফলস্বরূপ না পেরে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়।

চিত্র: পানির ফোঁটা আঁকারে বড় হলেই বাতাসের বাধায় তার মাঝে ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
এই ব্যাপারটা আমরা হাতের কাছেই দেখতে পাই। মগ বা জগ ভর্তি করে পানি উপরের দিকে ছুড়ে মারলে সেই পানিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলাকৃতির টুকরোয় বিভক্ত হয়ে যায়।

 শিশির, কুয়াশা, তুষার:

বায়ুমণ্ডলের উপরে সৃষ্টি হওয়া মেঘ আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে হলেও আমাদের হাতের কাছেই আছে মেঘের ছোট ভাই! কুয়াশা। বৃষ্টি, তুষার, কুয়াশা, শিশির এদেরকে আমরা আলাদা হিসেবে চিনলেও এরা আসলে একই জিনিস। এদের যেকোনো একটার ব্যাপারে জেনে গেলে সবগুলো সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। আবহবিদগণ এই জিনিসটাকে বলেন Precipitation বাংলায় এর পরিভাষা হতে পারে বারিপাত। এই প্রেসিপিটেশনের কয়েকটা প্রকারভেদের মাঝে একটা হচ্ছে বৃষ্টি। আরেকটা কুয়াশা। শীতের সময়ে ভূমি তাপ বিকিরণ করে খুব দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভূমির কাছাকাছি যে বাতাস থাকে সেগুলোও ভূমির সাথে সাথে ঠাণ্ডা হয়। ঠাণ্ডা হলেই ঘনীভূত হবার প্রবণতা দেখা যায়। আর নিচের বায়ুস্তরে বীজ হিসেবে আঁকড়ে ধরার জন্য ধূলির তো আর কোনো অভাব নেই। ফলে সহজেই কুয়াশার সৃষ্টি হতে পারে। পরে যখন সূর্য ওঠে তখন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় এবং আস্তে আস্তে কুয়াশা বিলীন হয়ে যায়।

চিত্র: শীতকালে ভূমি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে সৃষ্টি হয় কুয়াশা। 
বৃষ্টির পর বায়ুতে ভাসমান ধূলিবালি ধুয়ে নিচে চলে যায়। আর ধুলাবালি না থাকলে বাষ্পকণা একত্রে মিলে ঘনীভূত হতে পারে না। সেজন্য যে রাতে বৃষ্টি হয় সে সকালে কুয়াশা হতে দেখা যায় না।
এই কুয়াশাগুলোই যখন একটু একটু করে নিচে পড়ে তখন সেটি শিশির নাম ধারণ করে থাকে। বায়ুমণ্ডল অধিক পরিমাণ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তার জলীয় বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা কমে যায়। তাই সে ধারণ করা কুয়াশা অধিক পরিমাণ ঘনীভূত হয়ে শিশির রূপে নিচে পড়ে যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দূর্বা ঘাসের ডগায় কয়েকটি শিশির লেগে আছে আর সূর্যের আলো সেখানে প্রতিসরিত হয়ে মুক্তোর মত আভা ছড়াচ্ছে এমন একটা দৃশ্যের মত সুন্দর দৃশ্য মনে হয় পৃথিবীতে কমই হয়। এজন্যই হয়তো সুন্দরের কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।”

চিত্র: ঘাসের ডগার উপর শিশির কণার সৌন্দর্য যেকোনো সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
শীতের দেশে বছরের বেশিরভাগ সময়ের জন্যই আবহাওয়া শীতল থাকে। অধিক শীতলতার জন্য বৃষ্টি তরল হতে পারে না। সেটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফের কণা আঁকারে পড়ে। এটা তুষার বা স্নো। বৈশাখের মাসে যেমন শিমুল গাছ হতে তুলো ফেটে ফিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় তেমনি পেঁজা তুলোর মত তুষার বয়ে বেড়ায় শীতের দেশগুলোতে। তুষারপাতের সময় যে একটা শুভ্র সাদা দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা আসলেই দেখার মত।

চিত্র: পেঁজা তুলোর মত ভাসমান তুষার। 
মেঘের কোল হতে তুষার তার যাত্রা শুরু করে মাঝ পথে যদি বাতাসের সংস্পর্শে গলে যাবার পর আবার নিচের ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে বরফে পরিণত হয় তাহলে ভিন্ন ধরণের এক তুষারপাত হয়। এরা দানাদার ও ছোট ছোট আঁকারের হয়। এই ভিন্ন ধরণের বর্ষণকে বলে স্লিট।
তুষার কণাকে যদি মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরা হয় তাহলে তাদের অত্যন্ত সুন্দর গঠন লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকটা মৌলিক তুষারই ছয়টা দিকে প্রসারিত। প্রত্যেকটার মৌলিক গঠন ষড়ভুজের মত হলেও একটা তুষারের সাথে আরেকটা তুষারের কোনো মিল নেই।
চিত্র: তুষারের আণুবীক্ষণিক গঠন। তুষারের কেলাসগুলোর প্রত্যেকটিই ছয় দিকে প্রসারিত- কিন্তু একটির সাথে আরেকটির কোনো মিল নেই।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মরুভূমি:
একটা এলাকায় যদি বছরের অধিকাংশ সময়টাতেই বৃষ্টি হয় তবে সে বৃষ্টিকে ধরা হবে ‘অতিবৃষ্টি’ নামে। তখন সে এলাকাটাকে অতিবৃষ্টিবহুল এলাকা বলা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে প্রায় প্রত্যেকদিনই বৃষ্টি হয়। আর এমন প্রচুর বৃষ্টির ফলে সেখানকায় জন্ম নিয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। যে এলাকায় অধিক পরিমাণ বৃষ্টি হয় সে এলাকায় ভাল ফসল হয় না। মাটির উর্বরতা থাকে না। বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে ধুয়ে চলে যায়।
আবার কোনো এলাকায় দিনের পর দিন বৃষ্টি না হলে সে এলাকার মাটির সাথে মিশে থাকা পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায়। সূর্যের তাপে আস্তে আস্তে সমস্ত পানিই বাষ্পীভূত হয়ে চলে যায়। সারা বছরে মাঝে মাঝে দুয়েকবার বৃষ্টি হলেও পানির যে অভাব থেকে যায় সে অভাব সামান্য বৃষ্টিতে পূরণ হয় না। মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। দেখা দেয় খরা। এমন চলতে থাকলে সে এলাকা আস্তে আস্তে মরুভূমিতে পরিণত হয়।

চিত্র: বছরের বেশিরভাগ সময় যদি কোনো এলাকা বৃষ্টিহীন থাকে তাহলে সে এলাকায় খরা দেখা দেয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে একসময় মরুভূমিতে পরিণত হয়।
খরা চলাকালীন সময়ে আস্তে আস্তে তৃণভূমি বিলীন হয়ে যায়। বাস্তুসংস্থানের অমোঘ নীতির কারণে সেখানকার মানুষজনেরা খাদ্যের অভাবে ভোগে। অনাহারে দিন কাটাতে হয়। সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ। বিশাল মরুভূমি সাহারা আফ্রিকাতে অবস্থিত। আর আফ্রিকাতেই সাহারার আশ পাশের অঞ্চলের মানুষদের মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এত সহজে পার পাবার নয়। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি উভয়ই মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
কৃত্রিম বৃষ্টি:
একটা সময় প্রকৃতির প্রত্যেকটা আচরণই মানুষকে মেনে নিতে হত। সকল ক্ষেত্রেই প্রকৃতি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতো। আস্তে আস্তে মানুষ প্রকৃতিকে বশে আনতে পেরেছে। তেমনি বৃষ্টিও এসে গেছে মানুষের হাতের নাগালে। চাইলেই এখন মানুষ বৃষ্টি তৈরি করতে পারে। বের্গেরসন-ফিনডাইসন প্রক্রিয়া থেকে দেখা যায়, ঘনীভূত মেঘের মধ্যে বরফকণা রেখে দিলে সেখানে বৃষ্টির সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে এমন দেখা যায় আকাশে অনেক অনেক মেঘ আছে কিন্তু দিনের পর দিন বৃষ্টি হবার নামে নাম নেই। এমনটা হবার কারণ ঐ প্রভাবক-রূপে যার দরকার সেই অতিশীতল বরফ কণার অনুপস্থিতি। এমন অবস্থায় যদি কৃত্রিম ভাবে সেখানে বরফকণা ছিটিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেখানে বৃষ্টি নামানো সম্ভব। বরফ কণা তো আর এমন করে সরাসরি আসমানে ছুড়ে দেয়া যায়না। বরফ ছিটিয়ে দেয়া না গেলেও অন্য কোনো শীতল কণা ছিটিয়ে দিলেও কাজটা হয়ে যায়। তবে এখানে সামান্য একটু সমস্যা আছে। যেকোনো ধরণের পদার্থ দিলেই পানি এসে জমাট বাধবে না। যে সকল পদার্থ পানি-প্রেমী বা হাইগ্রোস্কোপিক (hygroscopic) তাদের গায়েই পানির কণা লেগে লেগে জমাট বাধে। এরকম পদার্থ আছে সিলভার আয়োডাইড, ড্রাই আইস, তরল প্রোপেন ইত্যাদি। এর মধ্যে ড্রাই আইস হচ্ছে কঠিনিত কার্বন ডাই-অক্সাইড। বরফের শুকনো অবস্থা বলে মনে করলে দারুণ ভুল হবে! কার্বন ডাই-অক্সাইড হচ্ছে গ্যাসীয় পদার্থ। একে প্রচণ্ড চাপে কঠিন অবস্থায় রূপান্তর করা যায়। ড্রাই আইসের তাপমাত্রা হয়ে থাকে হিমাংকের নিচে ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
ভূমি থেকে কামান দেগে কিংবা বিমানে করে উপরে মেঘের কাছে গিয়ে ড্রাই আইস বা অন্যান্য পানি প্রেমী অতিশীতল কণা ছিটিয়ে দিলে মেঘ জমাট বেধে বৃষ্টির সৃষ্টি করে। সে কী ঝমাঝম বৃষ্টি! এই প্রক্রিয়ায় সিলভার আয়োডাইডের ব্যবহার বেশি জনপ্রিয়।

চিত্র: ড্রাই আইসের টুকরো। 
১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী ল্যাংমুর ও শেইফার কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি তৈরি করতে সক্ষম হন। শেইফার বার্কশায়ার পাহারের উপর থেকে ড্রাই আইসের গুড়ো ছিটিয়ে দিয়ে প্রথম বৃষ্টি তৈরি করতে সক্ষম হন। সেজন্য তাকে কৃত্রিম বৃষ্টির জনক বলা হয়। এই প্রযুক্তির আধুনিক রূপের কথাও শুনা যায়। যেমন এখন চেষ্টা করা হচ্ছে লেজারের সাহায্যে কামান জাতীয় কোনো কিছু কিংবা বিমানের সাহায্য ছাড়াই ভূমিতে বসে বৃষ্টি নামানো। মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক অনেক খেলাই ভেস্তে যায় বৃষ্টির কারণে। কিন্তু এই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রয়োগ করে খেলার আগে ভাগেই বৃষ্টি নামিয়ে ফেলে মাঠকে বৃষ্টির আশংকামুক্ত করে ফেলা যায়। বর্তমান কালে FIFA, Olympic গেমস সহ অন্যান্য বড় বড় ইভেন্টে এটি প্রয়োগ করা হয়। ফলে খেলা চলারত অবস্থায় বৃষ্টি নামে না, মাঝপথে খেলা বন্ধ করে দিতে হয়না। তবে এই কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো কতটা পরিবেশ বান্ধব কিংবা এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার কতটা স্বাস্থ্যকর সেই প্রশ্নও তোলা হয়। মানুষের চেষ্টায় প্রকৃতি থেকে বৃষ্টি নামিয়ে নিলে সেটা বাস্তুসংস্থানের জন্য কতটা আঘাতহানী সেটাও ভেবে দেখার অবকাশ থেকে যায়।

চিত্র: কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর কৌশল। 

নোটঃ
[১] দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে যে সকল পাকিস্তানীরা চাকুরী কিংবা অন্যান্য সূত্রে থাকতো তারা সবাই বাংলাদেশ [পূর্ব-পাকিস্তান] ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। একজন লোক থেকে যায় বাংলাদেশে। পাকিস্তানে বাংলাদেশের মত এমন দারুণ বৃষ্টি হয় না তাই সে পাকিস্তানে যায় নি। বৃষ্টির শব্দ শুনতে না পারলে সে থাকতে পারবে না। সে বাংলাদেশের বৃষ্টির প্রেমে পড়ে যায়। (হুমায়ুন আহমেদের কোনো একটা আত্মজীবনীতে এ ঘটনাটার উল্লেখ আছে।)
[২] আবদ্ধ কক্ষে ক্রমাগত ইলেকট্রিক ফ্যান চলতে থাকলে ফ্যান কক্ষের ভিতরের বাতাসই ক্রমাগত নাড়াচাড়া করে যাবে। ফলে অল্প পরিমাণ হওয়াতে একসময় সমস্ত রুমের বাতাস গরম হয়ে যাবে। তখন যে বাতাসটা পাওয়া যাবে সেটা স্বস্তিদায়ক হয় না। যেটাকে আমরা গরম বাতাস বলে থাকি। তবে ঘরে ফাঁক-ফোঁকর থাকলে কিংবা জানালা খুলে রাখলে এমনটা হয় না। বাইরের ও ভিতরের বাতাসের চলাচল হয় তাই সমস্ত বাতাস গরম হয়ে যায় না।
[৩] জুল-থমসন প্রভাব: একটা ব্যাবস্থা বা সিস্টেমে কিছু পরিমাণ গ্যাসকে অধিক পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করে সংকুচিত করে নেয়া হয়। তারপর একটা প্লাগের ভিতর দিয়ে নিম্নচাপ বিশিষ্ট বিশাল আয়তনের কক্ষে হঠাৎ করে প্রসারিত হতে দিলে সে গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। তরলও হয়ে যেতে পারে। এটাই জুল-থমসন প্রভাব। এমনটা হবার কারণ, যখন গ্যাস সংকুচিত অবস্থায় থাকে তখন গ্যাসের অণুগুলোর মাঝে একধরণের আকর্ষণ বল ক্রিয়াশীল থাকে। অধিক চাপ থেকে হঠাৎ করে প্রসারিত হতে দিলে গ্যাসের অণুগুলোকে তাদের মাঝে বিদ্যমান আকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। কাজ সেটা বিরুদ্ধ হোক আর যাই হোক তা করতে গেলে শক্তির দরকার হবে। এই শক্তিটা গ্যাসের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করে নেয়। এতে করে গ্যাসের তাপমাত্রা কমে যায়।

[৪] বায়ুর বাষ্প ধারণের একটা সীমা আছে। যদি কোনো অঞ্চলের বায়ু তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বাষ্প ধারণ করে তবে সে বায়ুকে বলা হবে ‘সম্পৃক্ত’। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বায়ুর বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা বাড়ে। এমন অবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে আরও বেশি বাষ্প বায়ুতে মিশলে সে অবস্থাকে বলা হবে ‘অতি সম্পৃক্ত’। তাপমাত্রা আবার কমে গেলে বাতাসের ধারণক্ষমতা হ্রাস পাবে- আর তখন তার ধারণ করা কিছু বাষ্প নিচে ছেড়ে দিতে হবে। শীতের শিশিরের বেলায় এটাই ঘটে।
[৫] উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে প্রতি বছর ৫০৫,০০০ ঘন কিলোমিটার [১২১,০০০ ঘন মাইল] পানি ঝড়ে পড়ছে। তার মাঝে ৩৯৮,০০০ ঘন কিলোমিটার বা ৯৫ হাজার ঘন মাইল পানি সমুদ্রে এবং ১০৭,০০০ ঘন কিলোমিটার বা ২৬ হাজার ঘন মাইল পানি পড়ছে ডাঙ্গায়।

No comments:

Post a Comment